ধর্ম ডেস্ক ৫ এপ্রিল ২০২৪ , ১:২৬:৪৮ প্রিন্ট সংস্করণ
মাহে রমজানের শেষ জুমার দিন মুসলিম বিশ্বে ‘জুমাতুল বিদা’ নামে পরিচিত। এদিন রমজান মাসের শেষ জুমা হিসেবে ‘আল-কুদস দিবস’ পালিত হওয়ায় এর গুরুত্ব, তাৎপর্য ও মাহাত্ম্য অপরিসীম। সাপ্তাহিক জুমার নামাজ মুসলমানদের বৃহত্তর জামাতে অনুষ্ঠিত হয়। রমজান মাসের জুমাবার আরও বেশি গুরুত্বপূর্ণ ও ফজিলতময়। জুমাতুল বিদাসহ মাহে রমজানের প্রত্যেক জুমাবারে ইবাদত-বন্দেগিতে অধিক সওয়াব লাভের সুযোগ থাকে। সারা বিশ্বের ধর্মপ্রাণ মুসলমান মাসব্যাপী সিয়াম সাধনার পর শেষ শুক্রবার জুমার নামাজ আদায় করে মাহে রমজানকে বিদায় সম্ভাষণ জানান। পবিত্র কোরআনে জুমার নামাজ জামাতে আদায়ের নির্দেশ প্রদান করা হয়েছে, ‘হে মুমিনগণ! জুমার দিনে যখন নামাজের জন্য আহ্বান করা হয়, তখন তোমরা আল্লাহর স্মরণে ধাবিত হও এবং ক্রয়-বিক্রয় ত্যাগ কর। এটাই তোমাদের জন্য শ্রেয়, যদি তোমরা উপলব্ধি কর।’ (সূরা আল-জুমুআ, আয়াত-৯)
জুমাতুল বিদার তাৎপর্য ও মাহাত্ম্য সর্বাধিক। জুমার নামাজ অপরিহার্যভাবে জামাতের সঙ্গে আদায় করা আবশ্যক বিধায় একাকী পড়ার বিধান নেই। রমজান মাসের সর্বোত্তম দিবস হলো জুমাতুল বিদা, যা মাহে রমজানে পরিসমাপ্তিসূচক শেষ শুক্রবারে পালিত হয়। এদিন মুমিন মুসলমানদের ইমানি সম্মিলন হয়। এদিনে এমন একটি সময় আছে যে সময় মুমিন বান্দার মোনাজাত ও ইবাদত আল্লাহ বিশেষভাবে কবুল করেন। এ সময়টি হলো দ্বিতীয় খুতবার আজানের সময় থেকে সূর্যাস্তের পূর্ব পর্যন্ত। জুমার দিনের শ্রেষ্ঠত্ব ও ফজিলত সম্পর্কে রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, ‘সপ্তাহের সাত দিনের মধ্যে জুমাবার সর্বাধিক মর্যাদাবান ও নেতৃত্বস্থানীয় দিন। এ পুণ্য দিনে আদি পিতা হজরত আদম (আ.)-কে সৃষ্টি করা হয়। এদিন তিনি জান্নাতে প্রবেশ করেন। এদিন তিনি পুনরায় পৃথিবীতে আগমন করেন। এদিন তাঁর ইন্তেকাল হয়। এদিনেই কিয়ামত সংঘটিত হবে। এ পুণ্য দিনে এমন একটি সময় রয়েছে, যে সময় আল্লাহর দরবারে দোয়া কবুল হয়।’ (মিশকাত)
মাহে রমজানের বিদায়ী শুক্রবার ধর্মপ্রাণ মুসলমানদের জন্য অতি মূল্যবান। এদিন সিয়াম শেষ হয়ে যাওয়ার সতর্কতামূলক দিবস। জুমাতুল বিদা স্মরণ করিয়ে দেয় যে রোজার শেষ প্রান্তে এর চেয়ে ভালো দিবস আর পাওয়া যাবে না। রোজার শুরু থেকে যেসব ইবাদত ব্যস্ততাবশত ফেলে রাখা হয়েছে, যে গুনাহখাতা মাফের জন্য ক্ষমা প্রার্থনা করতে ভুল হয়েছে, জুমাতুল বিদার দিনে দোয়া কবুল হওয়ার সময়ে এর বরকত হাসিল করা বাঞ্ছনীয়। নবী করিম (সা.) বলেছেন, ‘যে মুসলমান রমজান মাস পেল, কিন্তু সারা বছরের গুনাহখাতা মাফ করিয়ে নিতে পারল না, তার মতো হতভাগা আর নেই।’
যে তিনটি বিষয় জুমাতুল বিদাকে আল্লাহর করুণা, দয়া, ক্ষমা তথা মাগফিরাত ও নাজাত লাভের দিবস হিসেবে চিহ্নিত করেছে, তা হচ্ছে মাহে রমজান, জুমাতুল বিদা এবং শেষ শুক্রবার ‘আল-কুদস দিবস’। জুমাতুল বিদার বিশেষ তাৎপর্য এই যে রমজান মাসের শেষ শুক্রবার আল্লাহর নবী হজরত দাউদ (আ.)-এর পুত্র মহামতি হজরত সুলায়মান (আ.) জেরুজালেম নগর প্রতিষ্ঠা করেন এবং আল্লাহর মহিমা তুলে ধরতে সেখানে পুনর্নির্মাণ করে গড়ে তোলেন মুসলমানদের প্রথম কিবলা ‘মসজিদ আল-আকসা’। মক্কার মসজিদুল হারাম ও মদিনার মসজিদে নববির পর তৃতীয় পবিত্রতম স্থান হচ্ছে ‘বায়তুল মোকাদ্দাস’ বা ‘মসজিদ আল-আকসা’।
রাসুলুল্লাহ (সা.) যে তিনটি মসজিদের উদ্দেশে সফরকে বিশেষভাবে সওয়াবের কাজ হিসেবে উল্লেখ করেছেন, এর অন্যতম হচ্ছে ‘বায়তুল মোকাদ্দাস’। ইসলামের ইতিহাসের অনেক গুরুত্বপূর্ণ ঘটনার সঙ্গে এর সংশ্লিষ্টতা রয়েছে। মসজিদ আল-আকসা এবং তার আশপাশের এলাকা বহু নবীর স্মৃতিবিজড়িত। এ মসজিদকে কেন্দ্র করে অসংখ্য নবী-রাসুলের দাওয়াতি মিশন পরিচালিত হয়েছে। এটি সব মুসলমানের ইমান ও সংস্কৃতির অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ। এখানে রয়েছে অসংখ্য নবী-রাসুলের মাজার। ওহি ও ইসলামের অবতরণস্থল, আম্বিয়া কিরামের দ্বীন প্রচারের কেন্দ্রভূমি, তাই এ পবিত্র নগরের প্রতি ভালোবাসা প্রত্যেক মুমিনের হূদয়ের গভীরে প্রোথিত। মহানবী (সা.)-এর নবুওয়াত প্রাপ্তির পর থেকে মুসলমানদের দ্বারা বায়তুল মোকাদ্দাস পবিত্র স্থান রূপে গণ্য হতে থাকে। কোরআন শরিফে বায়তুল মোকাদ্দাসকে পবিত্র ভূমি উল্লেখ করা হয়েছে, ‘(স্মরণ করো, মুসা তার সম্প্রদায়কে বলেছিল) হে আমার সম্প্রদায়! আল্লাহ তোমাদের জন্য যে পবিত্র ভূমি নির্দিষ্ট করেছেন, এতে তোমরা প্রবেশ করো এবং পশ্চাদপসরণ করো না, করলে তোমরা ক্ষতিগ্রস্ত হয়ে পড়বে।’ (সূরা আল-মায়িদা, আয়াত: ২১)
রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর মিরাজের নৈশভ্রমণের প্রথম পর্ব সংঘটিত হয়েছিল মসজিদুল হারাম থেকে মসজিদুল আকসা পর্যন্ত এবং দ্বিতীয় পর্ব ছিল মসজিদুল আকসা থেকে ঊর্ধ্বলোক। মিরাজে এ মসজিদেই রাসুলুল্লাহ (সা.) সমস্ত নবী-রাসুলের ইমামতি করেছিলেন। এ পরিভ্রমণে বায়তুল মোকাদ্দাসকে মাধ্যম রূপে মর্যাদা প্রদানের পেছনে এর পবিত্রতার স্বাক্ষর বহন করে। পবিত্র কোরআনে এ ভূখণ্ডের পবিত্রতা বা বিশেষ মর্যাদা সম্পর্কে বলা হয়েছে, ‘পবিত্র ও মহিমান্বিত তিনি, যিনি তাঁর বান্দাকে এক রজনীতে মসজিদুল হারাম থেকে মসজিদুল আকসায় পরিভ্রমণ করিয়েছিলেন, যার চতুষ্পার্শ্ব আমি বরকতময় করেছিলাম তাঁকে আমার নিদর্শন পরিদর্শন করার জন্য, নিশ্চয়ই তিনি সর্বশ্রোতা, সর্বদ্রষ্টা।’ (সূরা বনী ইসরাঈল, আয়াত: ১)
প্রতিবছর রমজান মাসের শেষ শুক্রবার সারা বিশ্বের ধর্মপ্রাণ মুসলমান বায়তুল মোকাদ্দাসে ইহুদিদের অবৈধ দখলের বিরুদ্ধে ঘৃণা প্রকাশ করেন এবং ইহুদি রাষ্ট্র ইসরায়েলের কবল থেকে পবিত্র ভূমি ফিলিস্তিন রাষ্ট্রকে মুক্ত করার জন্য নতুন শপথ গ্রহণ করে থাকেন। তাই মাহে রমজানের ‘জুমাতুল বিদা’ তথা শেষ শুক্রবারকে ‘আল-কুদস দিবস’ বলা হয়। রোজার সমাপনীসূচক জুমাতুল বিদার নামাজে মসজিদে বিশেষ মুনাজাতে রোজাদার মুসল্লিরা দেশ-জাতির উন্নয়ন, আল-কুদসের মুক্তি এবং মুসলিম উম্মাহর ঐক্য, সংহতি, শান্তি ও কল্যাণের জন্য আল্লাহর দরবারে ক্ষমা প্রার্থনা করেন।