অনলাইন প্রতিনিধি ২ এপ্রিল ২০২৪ , ১:২৯:০৫ প্রিন্ট সংস্করণ
বিএনপির মহাসচিব পদে থাকতে চান না মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর। কারামুক্তির পর দলের চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার সঙ্গে দেখা করে তিনি নিজেই বিষয়টি তুলে ধরেছেন বলে একাধিক সূত্র গণমাধ্যমকে নিশ্চিত করেছে। এদিকে অসুস্থ বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া সব ধরনের রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড থেকে দূরে আছেন। বর্তমানে তিনি রাজধানীর একটি হাসপাতালে চিকিৎসাধীন। দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান প্রবাসে। এ অবস্থায় দিন দিন রাজপথের প্রধান বিরোধী দল বিএনপির নেতৃত্বের সংকট বেড়েই চলেছে। টানা ১৮ বছর দলটি ক্ষমতার বাইরে। একদফা বাস্তবায়নের দাবিতে বছরের অধিক সময় ধরে চলা বিএনপির রাজপথের আন্দোলনে চূড়ান্ত সাফল্য আসেনি। এতে দলটির নেতা-কর্মীদের মধ্যে এক ধরনের হতাশা বিরাজ করছে। দলের সাংগঠনিক অবস্থা দিন দিন ভেঙে পড়ছে। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, পরিস্থিতি অনুযায়ী দল পরিচালনা করতে ব্যর্থ হয়েছে বিএনপি। দেশের বাস্তবতাকে উপেক্ষা করে লন্ডন থেকে দল পরিচালনা সম্ভব নয়। এমন বাস্তবতায় দলের মহাসচিবের নেতৃত্ব থেকে সরে যেতে চাইছেন মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর।
জানা যায়, মহাসচিব পদে পরিবর্তনের বিষয়টি সামনে আনেন বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর নিজেই। তিনি সম্প্রতি কারামুক্তির পর বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার সঙ্গে দেখা করে নিজের শারীরিক অবস্থার কথা জানান। গুরুত্বপূর্ণ পদে থেকে দায়িত্ব পালনে নিজের অক্ষমতার কথা তুলে ধরে মহাসচিব পদ ছেড়ে দিতে আগ্রহ প্রকাশ করেন। তবে বিএনপি চেয়ারপারসন বিষয়টি আমলে না নিয়ে তাকে কাজ চালিয়ে যাওয়ার অনুরোধ করেন। এই প্রেক্ষাপটে মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বিএনপি মহাসচিব পদে না থাকলে এ দায়িত্বে নতুন কে আসতে পারেন সে বিষয়ে দলটির শীর্ষ নেতাদের মধ্যে আলোচনা চলছে। তবে মির্জা ফখরুল ইসলামের মতো একজন সর্বজনগ্রাহ্য জনপ্রিয় নেতার মহাসচিব পদ থেকে অব্যাহতির প্রসঙ্গটি দলের নেতা-কর্মীদের মধ্যে অস্বস্তি তৈরি করেছে। দলের দায়িত্বশীল নেতাদের কেউ কেউ বলছেন, এটা নতুন কিছু নয়। দলের প্রয়োজনে নেতৃত্বে পরিবর্তন একটি স্বাভাবিক প্রক্রিয়া। এ অবস্থায় মহাসচিব পদে আগ্রহী একাধিক স্থায়ী কমিটির সদস্য বর্তমানে সক্রিয় ভূমিকা পালন করে চলেছেন। কারামুক্তির পর মির্জা ফখরুল ইসলাম গত ২০ ফেব্রুয়ারি খালেদা জিয়ার সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন। তিনি বিএনপি চেয়ারপারসনের কাছে দলের কিছু কঠিন চিত্র তুলে ধরেন। এরপর চিকিৎসার জন্য ৪ মার্চ তিনি সিঙ্গাপুর যান। স্বাস্থ্য পরীক্ষা শেষে ১৮ মার্চ মির্জা ফখরুল দেশে ফেরেন।জানা যায়, ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে বন্দি থাকা অবস্থায় মির্জা ফখরুলের প্রায় ৬ কেজি ওজন কমে যায়। ৭৭ বছর বয়সী এই রাজনীতিবিদ নানা জটিল রোগে ভুগছেন। একটু সুস্থ হওয়ার অপেক্ষায় তিনি চিকিৎসকের পরামর্শ মেনে চলছেন। এ অবস্থায় সংগঠনের নেতৃত্বে মির্জা ফখরুল ইসলাম থাকবেন, না অন্য কেউ আসবেন, সংগঠন কীভাবে চলবে- তা নিয়ে দলের মধ্যে চলছে নানা আলোচনা ও বিতর্ক। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, রাজনীতির ব্যাপারে মির্জা ফখরুলের এক ধরনের হতাশা তৈরি হয়েছে। বিশেষ করে গত ২৮ অক্টোবর থেকে বিএনপির আন্দোলনের ব্যর্থতা, নির্বাচন এবং সামনে যে বিএনপির জন্য অনিশ্চিত সময়, এটিই এই রাজনীতিবিদকে হতাশ করেছে। দু-একজন নেতার কাছে তিনি নির্বাচন-পরবর্তী বিশ্ব পরিস্থিতি এবং জনগণের নিরাসক্ত মনোভাব নিয়েও হতাশা প্রকাশ করেছেন। নির্বাচনের আগে তিনি যেরকম উদ্দীপ্ত ও আগ্রহী ছিলেন, সে আগ্রহ এখন হতাশায় রূপ নিয়েছে বলে জানা গেছে। মির্জা ফখরুল এ মুহূর্তে বিএনপি এবং দলের বাইরে সর্বত্র গ্রহণযোগ্য নেতা। কূটনৈতিক অঙ্গনেও তার ইতিবাচক ইমেজ রয়েছে, যা বিএনপির অন্য নেতাদের নেই।
বিএনপিতে নেতৃত্বের সংকট : বিএনপির চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া রাজনীতিতে সক্রিয় নন। বর্তমানে তিনি রাজধানীর একটি হাসপাতালে চিকিৎসাধীন। ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান দীর্ঘদিন প্রবাসে থেকে দলের নির্দেশনা দিচ্ছেন। টানা ১৮ বছর দলটি ক্ষমতার বাইরে। এ অবস্থায় বিএনপিতে নেতৃত্বের সংকট চলছে। এতে দলটির সাংগঠনিক কর্মকাণ্ডে এক ধরনের স্থবিরতা বিরাজ করছে। দলের তিন বছর মেয়াদের জাতীয় সম্মেলন আট বছর পার করেছে। প্রায় ৬০০ সদস্যের কেন্দ্রীয় কমিটির ১৩০টির মতো পদ শূন্য। বিএনপির সর্বোচ্চ নীতিনির্ধারণী ফোরাম স্থায়ী কমিটির ১৯ পদের মধ্যে বর্তমানে শূন্য আছে পাঁচটি। এ ছাড়া ভাইস চেয়ারম্যানের ১৩টি, উপদেষ্টা ১৫টি, সম্পাদক ও সহ-সম্পাদকসহ প্রায় শতাধিক পদ শূন্য। ৮২টি সাংগঠনিক জেলার মধ্যে অর্ধশতাধিক কমিটি মেয়াদোত্তীর্ণ। অধিকাংশ জেলায় আংশিক আহ্বায়ক কমিটি হলেও দীর্ঘদিনেও সম্মেলন ও পূর্ণাঙ্গ কমিটি হয়নি। গত আট বছরে কেন্দ্রীয় কমিটির সভা হয়েছে মাত্র একবার। আন্দোলন-সংগ্রামে বিএনপির মূল শক্তি দুটি সহযোগী ও ৯টি অঙ্গসংগঠন। এগুলোর সাংগঠনিক অবস্থাও বেহাল। চেইন অব কমান্ড ভেঙে পড়ায় সহযোগী ও অঙ্গসংগঠনগুলোয় তৈরি হয়েছে বিশৃঙ্খল অবস্থা। সব মিলিয়ে দুর্বল সাংগঠনিক কাঠামোর কারণে দায়সারা পালিত হচ্ছে দলটির আন্দোলন কর্মসূচি। কেন্দ্রীয় কমিটির বিভিন্ন পর্যায়ের অনেক নেতা মারা গেছেন। নিষ্ক্রিয় আছেন বা বাদ পড়েছেন কেউ কেউ। কেন্দ্রের পাশাপাশি জেলা-উপজেলাসহ সব স্তরেই স্থবির হয়ে আছে বিএনপির সাংগঠনিক কর্মকাণ্ড। নেতা-কর্মীরা বলছেন, প্রায় দেড় যুগ ক্ষমতার বাইরে থাকা বিএনপি নানা সংকটের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। তত্ত্বাবধায়ক সরকার প্রতিষ্ঠার দাবিতে আন্দোলনে কাটছে দীর্ঘ সময়। এ অবস্থায় সাংগঠনিক কাঠামো পুনর্গঠন কিংবা শক্তিশালী করার দিকে মনোযোগ দিতে পারছেন না দলটির নীতিনির্ধারকরা। তাদের দাবি, হামলা, মামলা, গ্রেফতার, নির্যাতনসহ ক্ষমতাসীন দল ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর তৎপরতার কারণে অনেক ক্ষেত্রেই সংগঠন গোছানোর কাজটি করা যাচ্ছে না।
নেতা-কর্মীরা বলছেন, এভাবে ভোট বর্জন করতে থাকলে দলের সাংগঠনিক ভিত্তি ধ্বংস হয়ে যাবে। আর একসময় দলের ওপর নিয়ন্ত্রণ হারাবেন হাইকমান্ড। লন্ডনে বসে দেশের বাস্তব অবস্থা পর্যবেক্ষণ করা যায় না।
সামগ্রিক প্রসঙ্গে দলটির ভাইস চেয়ারম্যান শামসুজ্জামান দুদু বলেন, মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরের সঙ্গে তিন মাস কারাগারে ছিলাম। ৭৭ বছর বয়সী মির্জা ফখরুলসহ আমরা কেউ ভালো চিকিৎসা পাইনি। সরকারের নানা অনিয়মের বিরুদ্ধে বক্তব্য-বিবৃতি দিচ্ছেন তিনি। আশা করি, আগামীতেও তিনি অতীতের মতোই রাজপথে সরব থাকবেন। তিনি বলেন, মির্জা ফখরুল ইসলাম আনুষ্ঠানিকভাবে পদ থেকে অব্যাহতি নেওয়ার কথা বলেননি। তিনি মহাসচিব পদে থাকতে চান না এমন কথা উদ্দেশ্যমূলকভাবে বলা হচ্ছে। দল মহাসচিব পদে পরিবর্তন আনলে আনুষ্ঠানিকভাবে জানানো হবে। আশা করি, তিনি মহাসচিব পদে আছেন, ভবিষ্যতেও থাকবেন।