সকালের দুনিয়া ডেস্ক ২৪ জুলাই ২০২৪ , ৮:১৪:৩৭ প্রিন্ট সংস্করণ
চার দফা ‘জরুরি দাবি’ পূরণে সরকারকে আরও দুই দিন সময় বেঁধে (আলটিমেটাম) দিয়েছেন বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সমন্বয়কেরা। তাঁরা বলছেন, চার দফা পূরণ হলেই কেবল তাঁদের মূল আট দফা দাবি নিয়ে আলোচনার পথ তৈরি হবে। কিন্তু সরকার চার দফা না মানলে আট দফা দাবি নিয়ে কথা বলার কোনো সুযোগ নেই।
বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের পাঁচজন সমন্বয়ক ও একজন সহসমন্বয়ক গতকাল মঙ্গলবার বিকেলে ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটি (ডিআরইউ) মিলনায়তনে সংবাদ সম্মেলন করেন। এই সংবাদ সম্মেলন শুরু হওয়ার আগেই ডিআরইউর সামনের সড়কে পুলিশের বিপুলসংখ্যক সদস্য অবস্থান করছিলেন।
সংবাদ সম্মেলনে চার দফা আবার তুলে ধরেন সমন্বয়কেরা। প্রথম দুটি দাবি হচ্ছে ইন্টারনেট সচল করা ও কারফিউ প্রত্যাহার করা। তৃতীয় দাবিটি হচ্ছে বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসগুলো থেকে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী সরিয়ে নিয়ে সরকার ও প্রশাসনের সমন্বয়ে সুষ্ঠু পরিবেশ নিশ্চিত করে আবাসিক হল খুলে দিয়ে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে শিক্ষার্থীদের ফিরে যাওয়ার পরিবেশ তৈরি করা। চতুর্থ দাবি হচ্ছে আন্দোলনের সমন্বয়কদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা।
এসব দাবি মানতে গত রোববার রাতে সমন্বয়কেরা সরকারকে দুই দিনের আলটিমেটাম দিয়েছিলেন। এর আগে গত শুক্রবার রাতে রাষ্ট্রীয় অতিথি ভবন পদ্মায় সরকারের তিনজন মন্ত্রীর সঙ্গে দেখা করে তাঁরা আট দফা দাবি জানিয়েছিলেন।
সরকারি চাকরিতে কোটা সংস্কারের দাবিতে গড়ে ওঠা শিক্ষার্থীদের একটি প্ল্যাটফর্ম বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন। তাঁদের গতকালের সংবাদ সম্মেলনে অন্যতম সমন্বয়ক সারজিস আলম বলেন, ‘আমরা সরকারের প্রতিনিধিদের কাছে আট দফা দাবি জানিয়ে এসেছিলাম। এরপর দুই দিন আগে জরুরি চারটি দাবি জানিয়ে এসেছি। এই চারটি দাবি পূরণ না করলে বাকি আটটি দাবি নিয়ে কথা বলার কোনো সুযোগ নেই। আমরা দুই দিনের আলটিমেটাম দিলেও এখনো এ বিষয়ে কোনো সাড়া পাইনি। আমরা আবার দুই দিনের একটি আলটিমেটাম দিচ্ছি ওই চারটি জরুরি দাবি মানার জন্য। আমরা চাই, বৃহস্পতিবারের মধ্যে সরকারের পক্ষ থেকে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের সঙ্গে কথা বলে সুষ্ঠু পরিবেশ তৈরি করা হোক, যাতে শুক্রবার সব ক্যাম্পাসে শিক্ষার্থীরা ফিরে যেতে পারেন। আমরা কবে আন্দোলনের শেষ ঘোষণা করব, তা পুরোপুরি নির্ভর করছে সরকারের ওপর।’
সারজিস আলম বলেন, কোটা সংস্কার আন্দোলন নিয়ে সরকারের যে মনোভাব এখন দেখা যাচ্ছে, সরকারের বিভিন্ন মন্ত্রী যে ধরনের সংবেদনশীল বক্তব্য দিচ্ছেন, এগুলো আগে বললে এটা কখনোই এ পর্যন্ত আসার কথা ছিল না। অসংখ্য পরিবারের যে ক্ষতিগুলো হয়ে গেল, সেগুলো আসলে কখনো পূরণ করা সম্ভব নয়।
প্রতি মুহূর্তে গ্রেপ্তার, তুলে নেওয়া ও শারীরিক-মানসিক নির্যাতনের ভয়ে আছেন বলেও জানান সারজিস আলম।
তাণ্ডব ও অগ্নিসংযোগে জানমালের যে ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে, তার দায় সরকার এড়াতে পারে না বলে মনে করেন আরেক সমন্বয়ক হাসনাত আবদুল্লাহ। গতকালের সংবাদ সম্মেলনে তিনি বলেন, আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীদের হত্যার সঙ্গে জড়িতদের দ্রুততম সময়ের মধ্যে বিচারের আওতায় আনতে হবে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় গ্রন্থাগারের সামনে থেকে আন্দোলন শুরু হয়েছিল। সেই গ্রন্থাগারের সামনেই শিক্ষার্থীদের নিয়ে আন্দোলনের পরিসমাপ্তি ঘটাতে চান তাঁরা। তবে এর জন্য সরকারকে সুষ্ঠু পরিবেশ তৈরি করতে হবে।
বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের আট দফা দাবির মধ্যে রয়েছে নিহতদের ঘটনা তদন্ত করে দায়ী ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে হত্যা মামলা করে গ্রেপ্তার ও বিচার। শহীদদের পরিবারকে আর্থিক সহযোগিতা, মাসিক ভাতা ও তাঁদের পিতা–মাতার মতামতের ভিত্তিতে একজন সদস্যকে চাকরির নিশ্চয়তা দেওয়া। সব পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের আবাসিক হলগুলোতে প্রশাসনিকভাবে সিট বরাদ্দ, সন্ত্রাসী কার্যক্রম বন্ধ করা এবং ছাত্র সংসদ চালু করা, কোটা সংস্কার আন্দোলনকারীদের বিরুদ্ধে করা সব মামলা প্রত্যাহার, কোটা সংস্কার আন্দোলনের সঙ্গে জড়িত সব শিক্ষার্থীকে সব ধরনের রাজনৈতিক, আইনি বা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশাসনের মাধ্যমে একাডেমিক হয়রানি না করার নিশ্চয়তা দেওয়া।
সংবাদ সম্মেলনে লুঙ্গি পরে এসেছিলেন সমন্বয়ক নাহিদ ইসলাম। তিনি বলেন, তাঁকে তুলে নিয়ে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী নির্যাতন করেছে।
নাহিদ বলেন, পরিকল্পিতভাবে আন্দোলনকে নস্যাৎ করতে দুর্বৃত্তরা বিভিন্ন ধরনের নাশকতা করে, বিভিন্ন রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানে আগুন দেয় ও জানমালের ক্ষয়ক্ষতি করে। প্রতিবাদী শিক্ষার্থীদের সঙ্গে এসব সহিংস ঘটনার কোনো সম্পর্ক নেই। সরকারের দায়িত্বহীন আচরণ ও দমনপীড়ন নীতির জন্য অরাজক পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে বলেও উল্লেখ করেন তিনি
নাহিদ ইসলাম বলেন, ‘সরকার প্রজ্ঞাপন (কোটা সংস্কারের বিষয়ে) দিয়েছে। কিন্তু আমরা সুস্পষ্টভাবে বলতে চাই যে আন্দোলনরত শিক্ষার্থী ও কোটা যাঁরা পান, তাঁরা কোটাব্যবস্থার একেকজন অংশীজন। সেই অংশীজনদের সঙ্গে আলোচনা-সংলাপ ছাড়া এ ধরনের প্রজ্ঞাপন সমীচীন নয়। আমরা চেয়েছিলাম সংলাপের মাধ্যমে সব পক্ষের সম্মতির ভিত্তিতে একটি প্রজ্ঞাপন হবে, যাতে নতুন করে আর কখনো সমস্যা তৈরি না হয়। সংলাপের যথাযথ পরিবেশ তৈরি করে শিক্ষার্থীদের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করে কোটা সংস্কারের চূড়ান্ত সমাধান আমরা চাই। আমরা সংবিধান অনুযায়ী অনগ্রসর জনগোষ্ঠীর জন্য কোটাব্যবস্থার কথা বলেছিলাম, মুক্তিযোদ্ধার সন্তানদের জন্য কোটার কথা বলেছিলাম। এই বিষয়গুলো প্রজ্ঞাপনে প্রতিফলিত হয়েছে। কিন্তু অনগ্রসর জনগোষ্ঠীর বিষয়টির আরও ক্লারিফিকেশন (ব্যাখ্যা) দরকার এবং অংশীজনদের সঙ্গে নীতিনির্ধারণী পর্যায়ের সংলাপ প্রয়োজন।’
এক প্রশ্নের জবাবে নাহিদ বলেন, সরকার এই প্রজ্ঞাপন দিতে যত রক্ত মাড়িয়েছে, যত লাশ পড়েছে, তা অনাকাঙ্ক্ষিত। এর জবাব চান তাঁরা। চার দফা দাবি মেনে নেওয়ার পর আট দফা নিয়ে সরকারের সঙ্গে সংলাপের দ্বার উন্মোচিত হবে উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘গত কয়েক সপ্তাহের ঘটনায় হতাহতের সঠিক সংখ্যা এখনো পাওয়া যায়নি। অনেক বাবা এখনো সন্তানের লাশ খুঁজে বেড়াচ্ছেন। এত রক্তের ওপর দাঁড়িয়ে আমরা কোটা সংস্কার চাইনি। আমরা সব হতাহতের বিচার চাই। আমাদের চূড়ান্ত দাবি ক্যাম্পাসগুলোতে গিয়ে সবার সঙ্গে আলোচনা করে জাতির সামনে পেশ করতে চাই। আমরা নিরাপত্তাহীনতায় আছি। আমরা এই পরিস্থিতির অবসান চাই। হতাহতের বিচার না হওয়া পর্যন্ত আন্দোলন অব্যাহত থাকবে।’
বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের অন্যতম সমন্বয়ক আসিফ মাহমুদ, আবু বাকের মজুমদার ও রিফাত রশীদকে ১৮ জুলাই থেকে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না বলে সংবাদ সম্মেলনে জানানো হয়। এর মধ্যে আসিফের বাবা মো. বিল্লাল হোসেন সংবাদ সম্মেলনে উপস্থিত হয়েছিলেন। তিনি বলেন, ‘পত্রিকায় আসিফের গুমের খবর দেখে কুমিল্লার মুরাদনগর থেকে আজ (মঙ্গলবার) ঢাকায় এসে ঢাকা মেডিকেল কলেজের মর্গে তালাশ করেছি। তাকে পাই নাই। এখন আমার একটাই আবদার, আসিফের সন্ধান চাই।
ছেলের সন্ধান চেয়ে যখন কথা বলছিলেন বিল্লাল হোসেন, তখন তাঁর পাশে বসা বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সমন্বয়ক হাসনাত আবদুল্লাহ কেঁদে ফেলেন। পরে আরেক সমন্বয়ক সারজিস আলম বলেন, আসিফ মাহমুদের বাবা ছেলের খোঁজে বিভিন্ন হাসপাতালের মর্গে যাচ্ছেন। এর চেয়ে বেদনাদায়ক ও ন্যক্কারজনক আর কিছু হতে পারে না।
আসিফ, বাকের ও রিফাত তিনজনই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র। তাঁদের মধ্যে রিফাত আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগে স্নাতক তৃতীয় বর্ষে পড়েন। এই বিভাগের সাবেক ও বর্তমান ২২ জন শিক্ষক রিফাত রশীদের নিখোঁজ হওয়ার ঘটনায় গতকাল উদ্বেগ জানিয়ে বিবৃতি দিয়েছেন। শিক্ষকদের মধ্যে আছেন অধ্যাপক সি আর আবরার, আকমল হোসেন, রাশেদ উজ জামান, মোহাম্মদ তানজীমউদ্দিন খান, রোজানা রশীদ, আবদুল মান্নান প্রমুখ।
শিক্ষকদের বিবৃতিতে রিফাতের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের প্রতি দাবি জানানো হয়েছে।