লেখকঃ উপপ্রধান তথ্য অফিসার, আঞ্চলিক তথ্য অফিস, পিআইডি, ময়মনসিংহ ২৭ মার্চ ২০২৪ , ৩:০৪:২৬ প্রিন্ট সংস্করণ
বর্তমানে চাকরি, পড়াশুনা, ব্যবসা আরও নানাবিধ কারণে প্রায়ই আমাদের বিদেশ যেতে হয়।
কিন্তু চাইলেই কি বিদেশ যাওয়া যায়? এজন্য কিছু সরকারি বিধি-বিধান ও নিয়ম-কানুন
মানতে হয়। তেমনি ময়মনসিংহ জেলার ফুলবাড়িয়া উপজেলার বাসিন্দা রাইসুল হাসান
সিদ্ধান্ত নেয় চাকরি নিয়ে সংযুক্ত আরব আমিরাত যাবে। এজন্য সবার আগে প্রয়োজন বৈধ
পাসপোর্ট। পাসপোর্ট তৈরির জন্য তিনি ময়মনসিংহ সদরের কাল্লু (ছদ্মনাম) নামের
দালালের সাথে যোগাযোগ করে। দালাল তাকে পাসপোর্ট দেবে বলে 20,000/- (বিশ হাজার)
টাকার চুক্তি করে। দিনের পর দিন চলে যাই রাইসুল আর পাসপোর্ট পায় না। রাইসুলের
একদিন চোখ পড়লো পত্রিকার পাতায়। কিভাবে খুব কম সময়ে অনলাইনের মাধ্যমে ই-
পাসপোর্ট করা যায় তা জানতে পারে।
ই-পাসপোর্টের ইতিহাস
২০১৬ সালে পাসপোর্ট সেবা সপ্তাহ উদ্বোধন কালে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা
সারা বিশ্বের সাথে তাল মেলাতে বাংলাদেশে ইলেকট্রনিক পাসপোর্ট বা ই-পাসপোর্ট
প্রবর্তনের ঘোষনা দেন। ২০১৭ সালে জিটুজি প্রক্রিয়ায় জার্মানির ভেরিডোস জিএমবিএইচ
এর সাথে ই-পাসপোর্ট প্রবর্তনে একটি সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষরিত হয়। সেই থেকে
যাত্রা শুরু। নানান পথ পরিক্রমা শেষে ২০২০ সালের ২২ জানুয়ারি প্রধানমন্ত্রী কর্তৃক
উদ্বোধনের মাধ্যমে শেষ হয় প্রতীক্ষার পালা, ই-পাসপোর্টের ক্ষেত্রে বাংলাদেশ প্রবেশ
করে নতুন এক যুগে। প্রাথমিক পর্যায়ে কেবল ঢাকা থেকে ই-পাসপোর্ট দেওয়া হলেও
বর্তমানে দেশের অভ্যন্তরে ৭০টি পাসপোর্ট অফিস এবং ৮০টি মিশন থেকে ই-পাসপোর্ট
সরবরাহ করা হচ্ছে।
ই-পাসপোর্টের কার্যক্রম ও বিশেষত্ব
ই-পাসপোর্ট প্রবর্তনের ফলে বিমানবন্দরসহ বিভিন্ন ইমিগ্রেশন পয়েন্টে দীর্ঘ লাইনের
চিরায়ত চিত্র বদলে যাবে। থাকবে ই-গেট, ফলে কোন পুলিশ কর্মকর্তা বা ইমিগ্রেশন
কর্মীর কাছে তথ্য যাচাইয়ের জন্য পাসপোর্ট হস্তান্তর করতে হবে না। ই-গেটের
নির্ধারিত স্থানে ই-পাসপোর্টটি রাখলে স্বয়ংক্রিয়ভাবে তথ্য যাচাই হয়ে যাবে, সব তথ্য
সঠিক পেলে প্রথম গেটটি খুলে যাবে, একটু সামনে এগোলেই একটি পর্দায় তার ছবি ভেসে
উঠবে, পাসপোর্টের ছবির সাথে ভ্রমণকারীর ছবি মিলে গেলে দ্বিতীয় গেটটিও
স্বয়ংক্রিয়ভাবে খুলে যাবে। অতঃপর নির্ধারিত কাউন্টার থেকে বহির্গমন বা আগমন সিল
দিয়ে তিনি সহজেই ইমিগ্রেশন সম্পন্ন করতে পারবেন। এম আর পি এবং ই-পাসপোর্ট
দেখতে একই রকম হলেও মূল পার্থক্য হচ্ছে নিরাপত্তা ব্যবস্থায়। ই-পাসপোর্টে
অ্যান্টেনাসহ পলিমারের তৈরি স্মার্টকার্ড প্রযুক্তি এবং মাইক্রোপ্রসেসর চিপ থাকে,
সেই চিপে পাসপোর্ট গ্রহীতার সব তথ্য সংরক্ষিত থাকে। সংরক্ষিত সেই ডেটাবেজের মধ্যে
থাকে পাসপোর্টধারীর তিন ধরনের ছবি, ১০ আঙ্গুলের ছাপ ও চোখের আইরিশ। ফলে যে
কোন দেশের কর্তৃপক্ষ সহজেই ভ্রমনকারীর সম্পর্কে সব তথ্য জানতে পারেন। এছাড়া ই-
পাসপোর্টে ৩৮টি নিরাপত্তা বৈশিষ্ট্য থাকায় এটি জালকরা প্রায় অসম্ভব।
ই-পাসপোর্ট পাওয়ার প্রক্রিয়া
আপনি যদি বাংলাদেশের নাগরিক হন এবং বয়সভেদে আপনার যদি জাতীয় পরিচয়পত্র
কিংবা জন্মনিবন্ধন সনদ (বিআরসি) থাকে তাহলে খুব সহজেই ৫টি ধাপ অনুসরণ করে পেতে
পারেন ই-পাসপোর্ট।ঘরে বসেই করা যাবে ই-পাসপোর্টের আবেদন। এজন্য প্রথমে আপনাকে
www.epassport.gov.bd ওয়েবসাইটে ঢুকে অ্যাপ্লাই অনলাইন বাটনে ক্লিক করে বর্তমান
ঠিকানা, এনআইডি/বিআরসি অনুসারে নাম,মোবাইল ও ইমেইল আইডি ব্যবহার করে একটি
একাউন্ট খুলতে হবে। এটা অনেকটা ফেসবুক একাউন্ট খোলার মতো। এই একাউন্ট ব্যবহার
করে সর্বোচ্চ ছয় জনের অনলাইন আবেদন সাবমিট করা যায়। দ্বিতীয় ধাপে অ্যাপ্লাই ফর
এ নিউ পাসপোর্ট অপসন ব্যবহার করে পাসপোর্টের ধরন(সাধারণ/অফিসিয়াল), ব্যক্তিগত
তথ্য (নাম, পেশা, ধর্ম ইত্যাদি), স্থায়ী ও বর্তমান ঠিকানা, যাচাইকরন আইডি
(এনআইডি/বিআরসি),পিতা-মাতা,স্বামী-স্ত্রী সংক্রান্ত তথ্য, জরুরি যোগাযোগ,
পাসপোর্টের পাতা ও মেয়াদ (৪৮/৬৪ পাতা, ৫/১০ বছর) এবং ডেলিভারি অপসন
(রেগুলার/জরুরী) সংক্রান্ত তথ্য দিতে হয়। এই তথ্যগুলো দিয়ে আবেদন সাবমিট করার পর
পাসপোর্টের পাতা ও মেয়াদ অনুসারে স্বয়ংক্রিয় পদ্ধতিতে পাসপোর্ট ফি নির্ধারিত হবে
এবং অনলাইন রেজিস্ট্রেশন আইডিসহ অন্যান্য তথ্য সমৃদ্ধ একটি আবেদন সারসংক্ষেপ
পাওয়া যাবে। এটি ব্যবহার করেই পরবর্তী ধাপগুলো সম্পন্ন করতে হবে। তৃতীয় ধাপে
নির্ধারিত পাসপোর্ট ফি জমা দিতে হবে।বাংলাদেশের তফসিলভূক্ত সকল সরকারী বেসরকারী
ব্যাংকে ‘এ’ চালানের মাধ্যমে এবং অনলাইনে কার্ড, মোবাইল ব্যংকিং, ইন্টারনেট ব্যাংকিং
ও ওয়ালেটের মাধ্যমে ফি প্রদান করা যাবে। ৪র্থ ধাপে বায়োমেট্রিক ইনরোলমেন্টের জন্য
আপনাকে বর্তমান ঠিকানার ভিত্তিতে স্বয়ংক্রিয়ভাবে নির্ধারিত পাসপোর্ট অফিসে
সশরীরে যেতে হবে। সেখানে প্রয়োজনীয় কাগজপত্র যাচাইকরে আপনার ছবি, চোখের
আইরিশ, দশ আঙ্গুলের ছাপ এবং স্বাক্ষর গ্রহন করা হবে। প্রযোজ্য ক্ষেত্রে পুলিশ
ভেরিফিকেশন রিপোর্ট প্রাপ্তির পর পাসপোর্ট অফিস আপনার পাসপোর্ট প্রিন্টিং এর
জন্য উত্তরাতে অবস্থিত পার্সোনালাইজেশন সেন্টারে পাঠাবে। পাসপোর্ট প্রিন্ট হয়ে
আসার পর স্বয়ংক্রিয়ভাবে আপনার মোবাইল ও ইমেইলে ম্যাসেজ পৌছে যাবে। ৫ম ও শেষ
ধাপে আপনাকে সংশ্লিষ্ট পাসপোর্ট অফিসে গিয়ে পাসপোর্টটি সংগ্রহ করতে হবে।
কোন পাসপোর্টে কত ফি
পাসপোর্টের মেয়াদ, পাতা সংখ্যা এবং ডেলিভারি সময়ের ওপর ভিত্তিকরে পাসপোর্ট ফি
নির্ধারিত হয়। বর্তমানে ৫ ও ১০ বছর মেয়াদী এবং ৪৮ ও ৬৪ পাতার পাসপোর্ট দেওয়া হয়
যা স্বাভাবিক, জরুরি ও অতিজরুরি পদ্ধতিতে ডেলিভারি পাওয় যায়। স্বাভাবিক ডেলিভারির
ক্ষেত্রে বায়োমেট্রিক এনরোলমেন্টের পর ১৫, জরুরির ক্ষেত্রে ০৭ এবং অতি জরুরির
ক্ষেত্রে ০২ কর্মদিবস বুঝাবে। ৫ বছর মেয়াদী ৪৮ পাতার পাসপোর্ট স্বাভাবিক সময়ে
পেতে ৪০২৫ টাকা,জরুরি ভিত্তিতে ৬৩২৫ এবং অতিজরুরি ভিত্তিতে পেতে ৮৬২৫ টাকা দিতে
হবে, আর ৫ বছর মেয়াদী ৬৪ পাতার পাসপোর্ট পেতে যথাক্রমে স্বাভাবিক ৬৩২৫ টাকা,
জরুরি ৮৬২৫ টাকা এবং অতি জরুরি ১২০৭৫ টাকা ফি প্রযোজ্য। অন্যদিকে ১০ বছর মেয়াদী
৪৮ পাতার পাসপোর্ট ফি নিয়মিত ৫৭৫০ টাকা, জরুরি ৮০৫০টাকা এবং অতি জরুরি ১০৩৫০
টাকা আবার ১০ বছর মেয়াদী ৬৪ পাতার পাসপোর্টের ক্ষেত্রে এই ফি যথাক্রমে ৮০৫০
টাকা, ১০৩৫০ টাকা এবং ১৩৮০০টাকা। উল্লেখ্য ১৮ বছরের নিম্নে ও ৬৫ বছর উর্ধ্বে
সকল আবেদনে ই-পাসপোর্টের মেয়াদ হবে ৫ বছর এবং ৪৮ পৃষ্ঠার।
ই-পাসপোর্টের জন্য যে সব কাগজপত্র প্রয়োজন
ই-পাসপোর্টের জন্য বয়সভেদে জাতীয় পরিচয়পত্র অথবা জন্মনিবন্ধন সনদ বাধ্যতামূলক;
আবেদনকারীর ১৮ বছরের নিম্নে হলে বিআরসি,১৮-২০ বছর হলে এন আইডি অথবা বি
আরসি দিয়ে আবেদন করা যাবে কিন্তু ২০ বছরের উর্ধ্বে হলে এন আই ডি আবশ্যক। তবে
১৮ বছরের কম আবেদনকারির ক্ষেত্রে পিতা অথবা মাতার এন আইডি থাকা বাধ্যতামূলক।
ই-পাসপোর্টের আবেদনের ক্ষেত্রে কোন ছবি সংযোজন করতে হয় না এবং কাগজপত্র
সত্যায়িত করার প্রয়োজন নেই। তবে ৬ বছরের কম বয়সী আবেদনকারীর ক্ষেত্রে ‘থ্রি
আর’ সাইজের গ্রে ব্যাকগ্রাউন্ডের ল্যাবপ্রিন্ট ছবি দাখিল করতে হবে।সরকারী
চাকরীজীবিদের ক্ষেত্রে প্রাসঙ্গিক জিও/এনওসি/পি আর এল অর্ডার/পেনশন বই সংযোজন
করতে হবে এবং ইস্যুকারী কর্তৃপক্ষের নিজ নিজ ওয়েব সাইটে আপলোড থাকতে হবে। অতি
জরুরী পাসপোর্টের ক্ষেত্রে নিজ উদ্যোগে পুলিশ ক্লিয়ারেন্স সনদ সংগ্রহ পূর্বক
আবশ্যিকভাবে আবেদনের সাথে দাখিল করতে হবে। বায়োমেট্রিক এনরোলমেন্টের সময়
আবেসনের সারাংশের প্রিন্ট কপি, সনাক্তকর আইডির ফটোকপি,পেমেন্ট স্লিপ, প্রযোজ্য
ক্ষেত্রে জিও/এনওসি, তথ্য সংশোধনের ক্ষেত্রে প্রয়োজনীয় কাগজপত্র এবং আবেদনের
প্রিন্ট কপি দাখিল করতে হবে। এছাড়া এসকল কাগজপত্রের মূলকপি সাথে রাখতে হবে।
পরিশেষে বলা যায় বিশ্বের ১১৯তম আর দক্ষিণ এশিয়ার প্রথম দেশ হিসেবে ই-পাসপোর্ট
জগতে বাংলাদেশের যে যাত্রা তা এক যুগান্তকারী অধ্যায়ের সূচনা করেছে। বিশ্বের যে কোন
দেশে নির্বিঘ্নে ভ্রমনেরর ক্ষেত্রে এদেশের মানুষ যেমন সুফল পাচ্ছে তেমনি উজ্জ্বল
হচ্ছে দেশের ভাবমূর্তি। ভোগান্তিহীন পাসপোর্ট প্রাপ্তিতে ই-পাসপোর্টের প্রবর্তন তাই
বাংলাদেশের অর্জনের ক্ষেত্রে এক মাইলফলক।