অপরাধ

বাড়ছে আত্মহত্যা, ১ বছরে বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয়ে ৪ শিক্ষার্থীর মৃত্যু

  ববি প্রতিনিধি: জাকিয়া সুলতানা শিমু ১৩ জুন ২০২৪ , ১১:৫৭:২১ প্রিন্ট সংস্করণ

বাড়ছে আত্মহত্যা, ১ বছরে বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয়ে ৪ শিক্ষার্থীর মৃত্যু
বাড়ছে আত্মহত্যা, ১ বছরে বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয়ে ৪ শিক্ষার্থীর মৃত্যু।

দেশে বাড়ছে আত্মহত্যা প্রবণতা, মাত্র ১ বছরের ব্যবধানে গলায় ফাঁস দিয়ে আত্মহত্যা করেছেন বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয়ের (ববি) ৪ ছাত্রী,আত্মহননের চেষ্টা করলেও বেঁচে গিয়েছেন অন্তত ১১ জন শিক্ষার্থী।আত্মহত্যাকারীদের প্রত্যেকে গলায় ফাঁস দিয়ে আত্মহত্যা করলেও পিছনে রয়েছে ভিন্ন ভিন্ন কারণ। এগুলোর কোনটার পিছনের কারণ সামনে আসেনি,শাস্তি পায়নি কেউ।

আত্মহননকারী শিক্ষার্থীরা হলেন,উদ্ভিদবিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষার্থী রিবনা শাহারিন, রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের বৃষ্টি সরকার, ফিন্যান্স এণ্ড ব্যাংকিং বিভাগের দেবশ্রী রায় এবং গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের শেফা নূর ইবাদি।

আত্মহত্যা চেষ্টা করেও বেঁচে যাওয়া মধ্যে ছাত্র ১০ এবং ছাত্রী রয়েছেন ১ জন। বঙ্গবন্ধু হলে ৩ আবাসিক ছাত্র, শেরেবাংলা হলে ৩ ছাত্র, শেখ হাসিনা হলে ১ ছাত্রী, রূপাতলী হাউজিং এলাকায় নিজ নিজ মেসে দুজন ছাত্র ও এক ছাত্রী, শেখ হাসিনা হলের সামনে এক ছাত্র এবং ঝালকাঠিতে নিজ বাসভবনে একজন ছাত্র আত্মহত্যার চেষ্টা করেন বলে জানা গেছে।

আত্মহত্যাকারী শিক্ষার্থীদের মাঝে ২০২১-২২ শিক্ষাবর্ষের শিক্ষার্থী রিবনা শাহরিন আত্মহত্যা করেন পারিবারিক কারণে। তার বাবা বেঁচে ছিল না, মায়ের সাথে চাঁচাদের অনৈতিক সম্পর্ক ছিল বলে জানা যায়। পরিবারিক অবহেলা এবং মায়ের এমন ঘৃণিত কর্মকাণ্ডে তার ভিতর চলে আসে এক ধরনের হতাশা ও একঘেয়েমি ভাব।১ম বর্ষের এই শিক্ষার্থীর বিশ্ববিদ্যালয়ে ছিল না কোনো বন্ধু , মিশতো না সহপাঠীদের সাথে।শেষ পর্যন্ত বেঁচে নেয় আত্মহত্যার পথ। ১৯ জুলাই,২০২৩ রাত ১০টার দিকে বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যের বাসভবনের পেছনে মোল্লা ছাত্রী নিবাসের একটি বন্ধ কক্ষ থেকে মৃত্যুর দুই থেকে তিন দিন পর ঐ ছাত্রীর অর্ধগলিত, ঝুলন্ত মৃতদেহ উদ্ধার করা হয়। রিবনার মায়ের দাবি, তার মেয়ে মানসিকভাবে কিছুটা বিকারগ্রস্ত ছিলো এবং সে একা থাকতে পছন্দ করতো। তার বাড়ি পিরোজপুর জেলার স্বরূপকাঠিতে।

গত ১৭ জানুয়ারি, ২০২৪ তারিখে প্রেম ঘটিত কারণে আত্মহত্যা করেছেন বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রী বৃষ্টি সরকার।বিশ্ববিদ্যালয়ের একই ব্যাচের ইংরেজি বিভাগের এক শিক্ষার্থীর সাথে তার প্রেমের সম্পর্ক ছিল।
মৃত্যুর কয়েকদিন আগে থেকে প্রেমিকের সঙ্গে মনোমালিন্য হয় তার। বৃষ্টি সরকারের আত্মহত্যার খবর জেনে তাৎক্ষণিকভাবে মানসিক বিকারগ্রস্ত হয়ে পড়েন প্রেমিক।

বিশ্ববিদ্যালয়ের ২০১৬-১৭ শিক্ষাবর্ষের স্নাতকোত্তরের শিক্ষার্থী দেবশ্রী রায় স্বামীর সাথে পারিবারিক কলহ ও সাংসারিক অশান্তির কারণে আত্মহত্যা করেন ১৭ মার্চ।বাবার বাড়ি সাতক্ষীরা এবং স্বামীর বাড়ি খুলনা হলেও স্বামীর কর্মস্থল বরগুনা সদর থানায় একটি ভাড়া বাসায় ফ্যানের সাথে ঝুলে আত্মহত্যা করেন তিনি। প্রেমের বিয়ের মাত্র তিন মাস পর আত্মহত্যা করেন এই শিক্ষার্থী। দেবশ্রী রায় ও স্বামী কঙ্কন রায়ের মাঝে প্রায়ই ঝগড়া হতো। নানা কারণে মেয়ের উপর শারীরিক ও মানসিক নির্যাতন করতো বলে জানান দেবশ্রীর বাবা-মা।

সর্বশেষ ৯ জুলাই বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের স্নাতক চতুর্থ বর্ষের শিক্ষার্থী শেফা নূর ইবাদি আত্মহত্যা করেছেন। প্রেম ঘটিত কারণে তিনি আত্মহত্যা করেছেন বলে প্রাথমিকভাবে জানা গেছে। তার প্রেমিকও একই বিশ্ববিদ্যালয়ের এবং একই ব্যাচের শিক্ষার্থী।

আত্মহত্যা প্রবণতার কারণ

ফরাসি সমাজবিজ্ঞানী এমিলি ডুর্খেইম আধুনিক সমাজে আত্মহত্যার কারণ খুঁজতে গিয়ে ভৌগোলিক, উত্তরাধিকার, মনস্তাত্ত্বিক ও আর্থিক কারণ অপেক্ষা সামাজিক কারণ বা সামাজিক উপাদানের ওপর অধিক গুরুত্ব আরোপ করেন। তার মতে, সামাজিক জীবনে সংহতির স্বল্পতা ও গভীরতার ওপর আত্মহত্যা নির্ভরশীল। অন্য কথায়, ব্যক্তি ও সমাজের মধ্যে পার্থক্য যখন ব্যাপক, তখন ব্যক্তি আত্মহত্যা করে। আধুনিক মানুষ সাধারণত দুটো কারণে নিজেকে হত্যা করে।

প্রথমত, আধুনিক সমাজে সংহতির অভাব; দ্বিতীয়ত, সঠিক মূল্যবোধের অভাব। ব্যক্তির সঙ্গে সমাজ ব্যবস্থা নৈকট্যের মাত্রার ওপরে ওই ব্যক্তির আত্মহত্যার প্রেষণা নির্ভরশীল। ব্যক্তির অবস্থান যখন দুটি বিপরীত মেরুতে হয় তখন তার আত্মহত্যার প্রেষণা বৃদ্ধি পায়। অর্থাৎ ব্যক্তি যখন অতীব ঘনিষ্ঠভাবে কিংবা অত্যন্ত ক্ষীণভাবে সমাজের সঙ্গে সম্পৃক্ত হয় তখনই তার আত্মহত্যার প্রেষণা জাগে।

ববি শিক্ষার্থীদের মতে,যারা আত্মহত্যা করেছেন তাদের বেশিরভাগই আত্মকেন্দ্রিক ছিলেন এবং তারা বন্ধুবান্ধবদের সাথে মিশতেন না। এতে তারা খুব অল্পতেই হতাশাগ্রস্ত হয়ে যেত। এর বাইরে বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই প্রেম ঘটিত কারণ জরিত। তাই কেউ হতাশাগ্রস্ত হলে বা ফেসবুকে এমন পোস্ট করলে সকলের উচিত তার সাথে সুসম্পর্ক বজায় রাখা। অনৈতিক সম্পর্কে না জরানোই ভালো।

আত্মহত্যার বিষয় জেনে দুঃখ প্রকাশ করে বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক ড.
বদরুজ্জামান ভূঁইয়া বলেন, আমরা ইতোমধ্যে কাউন্সিলিংয়ের ব্যবস্থা গ্রহণ করেছি।কয়েকদিন আগেও এই বিষয়ে একটি কাউন্সিলিং সেমিনার হয়েছে। বর্তমানে বিশ্ববিদ্যালয়ে মনোরোগ বিশেষজ্ঞ এসে মাসে ২ দিন করে সেবা দেন,তারা সরাসরি শিক্ষার্থীদের সাথে কথা বলেন। আমরা ইতোমধ্যে মনোরোগ বিশেষজ্ঞ চেয়ে ইউজেসিতে চিঠি দিয়েছি। অতি শীগ্রই বিশ্ববিদ্যালয়ে স্থায়ীভাবে একজন মনোরোগ বিশেষজ্ঞ পাবো। এর বাইরে শিক্ষার্থীদের সাথে শিক্ষকদের আরো আন্তরিক ও বন্ধুত্বসুলভ আচরণ করার পরামর্শ দেন তিনি।

আত্মহত্যা নিয়ে মনোবিজ্ঞানীরা যা বলছে,

সাম্প্রতিক সময়ে আত্মহত্যা প্রবণতা বৃদ্ধির কারণ হিসেবে প্রেম-ভালোবাসা ও পরকীয়াকেই বেশি দায়ী করছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মনোবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক অধ্যাপক ড. আ.ক.ম.রেজাউল করিম। তিনি দৈনিক মানবজমিনকে বলেন,বর্তমানে শিক্ষার্থীরা প্রেম- ভালোবাসায় জরিয়ে পড়ছে,আবার কেউ কেউ পরকীয়া করছে।শিক্ষার্থীদের মাঝে সম্পর্কের কিছুদিনের মাঝেই তাদের মাঝে বিবাহবহির্ভূত শারীরিক সম্পর্ক গড়ে উঠে।
বর্তমানে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের ব্যাপক প্রসারে সেই হার অনেক বেড়ে গেছে।আবার একই ব্যক্তি একসাথে একাধিক সম্পর্ক করছে। অনেক সময়ই দেখা যায়, একটা মেয়ের সাথে অনেকগুলো ছেলে প্রেম করতে চায়,সুতরাং খুব সহজেই সে অন্য একজনের সাথে সম্পর্কে জরিয়ে যেতে পারে।কিন্তু ছেলেরা সেটা খুব সহজে পারে না।
আবার শারিরীক সম্পর্ক করে ছেলেরা অনেক সময় ব্লাকমেইল করে।বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই দেখা যায়, তাদের মাঝে যেকোনো একজন প্রতারণা করে,অন্যজন সেটা মেনে নিতে পারে না।তখন অতিরিক্ত আবেগী হয়ে আত্মহননের পথ বেছে নেয়।এছাড়াও পারিবারিক অশান্তি, হতাশার কারণেও মানুষ আত্মহত্যা করে,তবে বেশিরভাগ শিক্ষার্থী প্রেম ঘটিত কারণেই আত্মহত্যা করেন বলে উল্লেখ করেন তিনি।

তিনি জানান ,মনোবিজ্ঞানের গবেষণামতে, যখন কেউ কারো সাথে প্রতারণা বা অন্যায়-অত্যাচার করে,তখন ভুক্তভোগীও তার প্রতিশোধ নিতে চায়।কিন্তু যখন সেটা নিতে ব্যার্থ হয় তখন সে নিজের উপরে প্রতিশোধ নেয়। এজন্য অনেকে হাত কাটে,নেশা করে, বিভিন্ন ধরনের আত্মঘাতী সিদ্ধান্ত নেয়,এমনকি আত্মহননের পথও বেছে নেন।

আত্মহত্যা প্রবণতা কামানো উপায় হিসেবে তার পরামর্শ ,এক্ষেত্রে বিশ্ববিদ্যালয়ে কাউন্সিলের ব্যবস্থা করা।শিক্ষক ও অভিভাবকের উচিত শিক্ষার্থীদের সাথে আরো বন্ধু-সুলভ সম্পর্ক রাখা,তাদের মোটিভেশন দেওয়া, তাদের সমস্যাগুলো জানা ও সমাধানের চেষ্টা করা।এছাড়াও বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃকপক্ষের মানসিক সমস্যা নিয়ে কাজ করা ও স্থায়ীভাবে মনোরোগ বিশেষজ্ঞ নিয়োগ দেওয়া।

আরও খবর

                   

সম্পর্কিত